দেশের ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের সাড়ে তিন হাজারের
বেশি শিক্ষকের এমপিওভুক্তি আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো। আন্দোলন কর্মসূচি
দিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিলেও এবার পুলিশি বাধায় ঘরে ফিরতে হয়েছে
তাদের। উল্টো লাঠিপেটা খেয়ে খালি হাতেই ফিরেছেন শিক্ষকরা।
বাংলাদেশ
বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন
বলেন, ‘৩২ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছি বিভিন্ন সরকারের সময়ে। বর্তমান
সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল— এমপিওভুক্ত হতে পারবো, কিন্তু এবার জুটেছে
পুলিশি নির্যাতন।’
বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের ব্যানারে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ওইদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষক প্রতিনিধিদের ডেকে নেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে।
আন্দোলনকারী শিক্ষকরা জানান, প্রথম দিনই শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মেহরাব হোসেনসহ ছয় জন শিক্ষক প্রতিনিধি বৈঠক করেন। শিক্ষা উপদেষ্টা বৈঠকে জানিয়ে দেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ বৈঠক করে বুধবার (১৬ অক্টোবর) সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন বৈঠক করে শিক্ষকদের মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে আশ্বস্ত হতে পারেননি। বুধবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর শিক্ষকরা শিক্ষা ভবনের সামনের রাস্তা অবরোধ করে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রমনা পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের আশ্বাস দেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার, তবে শিক্ষকদের রাস্তা ছাড়তে হবে। পুলিশের কথায় শিক্ষকরা রাস্তা ছেড়ে চলে যান। তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) শিক্ষক প্রতিনিধি দলকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্দেশে যেতে দেয় পুলিশ।
আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক শিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন উপদেষ্টার একান্ত সচিব। তিনি জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠালে নির্বাহী আদেশ করে দেওয়া হবে। কিন্তু শিক্ষকরা তাতে আশ্বস্ত হতে না পেরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অভিমুখে লং মার্চ শুরু করেন। এতে পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশ আমাদের লাঠিচার্জ করেছে, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে ছত্রভঙ্গ করেছে এবং জলকামান ব্যবহার করেছে। এতে বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মেহরাব হোসেন, হুমায়ুন কবির সুমন, নুরুল আবছার সিকদার, জয়নাল আবেদীন, সুজা উদ্দিন, আবদুল মালেক কাজল, জহিরুল হক, আবুল আলা শিবলী, তৌহিদুর রহমান, শারমিন, রোকসানা ও তানিয়াসহ ৩৩ জন শিক্ষক আহত হন। আমরা জীবন বাঁচাতে আন্দোলন স্থগিত করে রাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করেছি। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) আমরা সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছি। দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমাদের সামনে রেখেই শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। শিক্ষা উপদেষ্টা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলেছেন, শিক্ষকদের এমপিও করে দেবো। আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জানতে চেয়েছেন পুলিশ কেন শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উপাচার্যের কাছে আহত শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছেন এবং জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।’
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে মোবাইলে ম্যাসেজ দেওয়া হলেও তিনি তার কোনও জবাব দেননি।
একইদিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ’র সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে ম্যাসেজ দিলেও জবাব দেননি।
বৈঠকের পর বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মেহরাব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বৈঠকে আমাদের যেভাবে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তাতে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হতে পারেননি। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ বিষয়ে ভূমিকা রাখছেন।
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন বলেন, ‘আমরা আপাতত অবস্থা কর্মসূচি কর্মসূচি স্থগিত রেখেছি। আজ শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করে এমপিওভুক্তি দাবি জানিয়েছি সরকারের কাছে। আর পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি করেছি। যতদিন আমাদের এমপিওভুক্ত করা না হবে ততদিন আমাদের দাবি আদায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি চলতে থাকবে। কর্মসূচির মধ্যে আগামী ২৩ ও ২৪ অক্টোবর জেলায় জেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হবে। আর আগামী ত্রিশ অক্টোবরের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং এমপিওভক্তির সুনির্দিষ্ট কোনও দিকনির্দেশনা না এলে আমরা সারাদেশে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ শিক্ষা ভবনের সামনে আমরণ কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হবো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জনবল কাঠামোতে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা নেই। সে কারণে তাদের এমপিওভুক্ত করা যাচ্ছে না। ডিগ্রি স্তরের শিক্ষকরা জনবল কাঠামোতে রয়েছে সে কারণে তারা এমপিওভুক্ত হতে পেরেছেন। ২০১৮ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠক করে অনেক বিষয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে সংশোধনের কোনও পর্যায়ে বিগত সময়ে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
শিক্ষকরা জানান, দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা বঞ্চিত। এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার দাবিতে ২০২০ সালে জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টারদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক ও জনবল কাঠামো নিয়ে ভাবছি। এর সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত, তাদের সঙ্গে কিছুটা কথা হয়েছে। আমরা বসবো এই বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই সমাধান করার জন্য।’
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২০২২ সালে এবং ২০২৩ সালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘এমপিওভুক্ত করতে হলে জনবল কাঠামো সংশোধন করতে হবে। এমপিওভুক্ত করতে হলে আমাদের জনপ্রশাসনে যেতে হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়, আমরা এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে যখন পাঠাই তারপর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আমরা আশা করছি, অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করবে।’
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির এই আশ্বাসের পর ওই সময়ের সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সুরাহা করতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। বর্তমানে নতুন সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে। কিন্তু তাতেও আশাহত হন শিক্ষকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি কলেজের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রিস্তর পর্যন্ত পরিচালিত এমপিওভুক্ত কলেজগুলোয় ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধিবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত স্কেলে শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় অনুমোদন নেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কলেজের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এই কারণে কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে স্থান পায়নি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ। ফলে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হন তারা। আর বিগত ৩১ বছরের বেশি সময়েও এই সমস্যার সমাধান হয়নি।
Post a Comment